শ্রীমদ্ভগবদ গীতা

ভগবান শ্রী কৃষ্ণা

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে অর্জুনকে শ্রীমদ্ভগবদগীতা জ্ঞান দান করেন

গীতার উপদেশ

Lord Krishna - বর্তমানে বাঁচতে শেখো

বর্তমানে বাঁচতে শেখো

অতীত এবং ভবিষ্যতের চিন্তা করা উচিত নয়। কারণ যা হওয়ার তাই-ই হবে। যা হয়, ভালোর জন্য হয়। তাই অতীত ও ভবিষ্যতের চিন্তা ছেড়ে বর্তমানে বাঁচতে শেখা উচিত।

আত্মভাবে থাকাই মুক্তি

নাম, পদ, প্রতিষ্ঠা, ধর্ম, স্ত্রী বা পুরুষ আমরা নই। এই শরীরও আমাদের নয়। অগ্নি, জল, বায়ু, পৃথিবী, আকাশ দিয়ে এই শরীর নির্মিত। অবশেষে এই পঞ্চভূতেই বিলীন হবে। কিন্তু আত্মা স্থির, আমরা আত্মা। আত্মা কখনও মরে না। আত্মার জন্ম বা মৃত্যু হয় না। আত্মভাবে থাকাই মুক্তি।

নিজের কাজ করুন

অন্য কারও কাজ পূর্ণ করার চেয়ে ভালো, নিজের কাজ করুন। অপূর্ণ হলেও ব্যক্তিকে নিজের কাজই করা উচিত।

Lord Krishna - সমস্ত কিছুই পরিবর্তনশীল

সমস্ত কিছুই পরিবর্তনশীল

পরিবর্তন সংসারের নিয়ম। এখানে সমস্ত কিছু পরিবর্তনশীল। তাই, সুখ, দুখ, লাভ, ক্ষতি, জয়, পরাজয়, মান, অপমান ইত্যাদির মধ্যে একটি স্থানে অবস্থিত থেকে জীবন উপভোগ করা উচিত।

প্রেমের মাধুর্য

নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখুন। রাগের ফলে ভ্রম সৃষ্টি হয়। এই ভ্রম বুদ্ধিকে বিচলিত করে তোলে। এর ফলে বুদ্ধি নাশ হয়। ব্যক্তি পতনের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। রাগ, কামবাসনা ও ভয়— এগুলি আমাদের শত্রু।

মমত্বকে জীবিত রাখুন

সকলের প্রতি মমতা, সমস্ত কাজে কুশলতা ও দুঃখ রূপী সংসার থেকে বিয়োগের নামই যোগ।

Lord Krishna - ঈশ্বরের প্রতি সমর্পিত থাকুন

ঈশ্বরের প্রতি সমর্পিত থাকুন

নিজেকে ঈশ্বরের চরণে নিবেদন করে দাও। ঈশ্বর আমাদের রক্ষা করবেন এবং আমরা দুঃখ, ভয়, চিন্তা, শোক ও বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারব।

দৃষ্টিকোণ শুদ্ধ রাখুন

নিজের দৃষ্টিকোণ শুদ্ধ রাখতে হবে। জ্ঞান ও কর্মকে এক রূপে দেখতে হবে। এর ফলে আমাদের দৃষ্টিকোণে পরিবর্তন আসবে।

মন শুদ্ধ রাখুন

মন শুদ্ধ রাখতে হবে। মন যদি শুদ্ধ হয়, তাহলে আমরা ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগ করতে পারব।

Lord Krishna - মন শান্ত রাখুন

মন শান্ত রাখুন

অশান্ত মনকে শান্ত করার জন্য অভ্যাস ও বৈরাগ্যকে নিজের মনে পাকাপোক্ত স্থান দিন। না-হলে অনিয়ন্ত্রিত মন আমাদের শত্রুতে পরিণত হবে।

কাজ করার আগে বিচার করুন

আমরা যে কর্মই করি না কেন, তার ফল আমাদেরই ভোগ করতে হয়। তাই কর্ম করার আগে বিচার করা উচিত।

সমস্ত কিছুই পরিবর্তনশীল

পরিবর্তন সংসারের নিয়ম। এখানে সমস্ত কিছু পরিবর্তনশীল। তাই, সুখ, দুখ, লাভ, ক্ষতি, জয়, পরাজয়, মান, অপমান ইত্যাদির মধ্যে একটি স্থানে অবস্থিত থেকে জীবন উপভোগ করা উচিত।

অধ্যায় সমূহ

প্রথম অধ্যায়

অর্জুনবিষাদ যোগ

শ্রীমদ্ভাগবত গীতার প্রথম অধ্যায়, "অর্জুন-বিষাদ যোগ," আমাদের জীবনের সংকট ও দ্বিধার মুহূর্তে মূল্যবান শিক্ষা প্রদান করে। এই অধ্যায়ে মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে, অর্জুন যখন তার আত্মীয়স্বজন, গুরুজন ও বন্ধুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তখন তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। এই অবস্থায়, তিনি তার কর্তব্য নিয়ে সংশয়ে পড়েন এবং হতাশায় নিমজ্জিত হন।
এই অধ্যায় থেকে আমরা শিখতে পারি যে জীবনের সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে কিভাবে আমাদের সিদ্ধান্তহীনতা এবং মানসিক দ্বিধা আমাদের কর্তব্য পালনে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। অর্জুনের এই মানসিক দুর্বলতা বোঝায় যে, জীবনে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি ও নির্দেশনা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে শ্রীকৃষ্ণের উপদেশের মাধ্যমে অর্জুন তার সংকট কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হন, যা আমাদেরকে শেখায় যে জীবনের কঠিন সময়ে সঠিক উপদেশ ও অন্তর্দৃষ্টি কতটা কার্যকরী হতে পারে।

46 শ্লোক

দ্বিতীয় অধ্যায়

সাংখ্য যোগ

শ্রীমদ্ভাগবত গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়, "সাংখ্য যোগ" বা "জ্ঞানযোগ," আমাদের জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নিজ দায়িত্ব পালনের গুরুত্ব শেখায়। এই অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে কর্ম ও কর্তব্য সম্পর্কে বিশদভাবে জ্ঞান দেন। তিনি আত্মা ও শরীরের পার্থক্য তুলে ধরে বলেন, আত্মা অবিনশ্বর ও অমর, যা শরীর পরিবর্তন করলেও অমলিন থাকে। ফলে, মৃত্যুভয় বা দুঃখকে অতিক্রম করে নিজের কর্তব্য পালন করার কথা শেখানো হয়। এই অধ্যায় থেকে আমরা শিখি, নিষ্কাম কর্ম বা ফলের প্রতি আসক্তি ত্যাগ করে কাজ করা উচিত। সঠিক জ্ঞান, স্থিতধী মনোভাব, এবং নিজের দায়িত্ব পালনই আমাদের জীবনকে সার্থক করে তুলতে পারে।

72 শ্লোক

তৃতীয় অধ্যায়

কর্ম যোগ

শ্রীমদ্ভাগবত গীতার তৃতীয় অধ্যায়, কর্মযোগ, আমাদের কর্ম ও কর্তব্য সম্পর্কে গভীর শিক্ষা দেয়। এই অধ্যায়টি শিক্ষা দেয় যে, প্রত্যেক মানুষের উচিত নিজের দায়িত্ব পালন করা, তবে সেটি নিঃস্বার্থভাবে ও ঈশ্বরের প্রতি নিবেদন করে করা উচিত। নিজস্ব আকাঙ্ক্ষা বা ফলের আশা ত্যাগ করে কাজ করাই প্রকৃত যোগ। এতে বলা হয়, কর্ম থেকে কেউ বিরত থাকতে পারে না, কারণ কর্ম প্রাকৃতিক ও অপরিহার্য।
গীতার তৃতীয় অধ্যায় আমাদের শেখায়:
1. নিজ নিজ দায়িত্ব পালন: প্রত্যেককে নিজের ধর্ম ও কর্তব্য পালন করতে হবে।
2. নিঃস্বার্থতা: কাজের ফলে প্রাপ্তির আশা না রেখে তা ঈশ্বরকে উৎসর্গ করা উচিত।
3. সমাজের কল্যাণে কাজ: নিজের উন্নতি ছাড়াও সমাজ ও জগতের কল্যাণের জন্য কাজ করা জরুরি।
4. কর্ম ও জ্ঞান সমন্বয়: কর্মযোগ জীবনের ভারসাম্য আনতে সাহায্য করে।

43 শ্লোক

চতুর্থ অধ্যায়

জ্ঞান যোগ

শ্রীমদ্ভাগবত গীতার চতুর্থ অধ্যায় "জ্ঞান যোগ" আমাদের প্রকৃত জ্ঞানের গুরুত্ব ও তা অর্জনের পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষা দেয়। এই অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ ব্যাখ্যা করেছেন কীভাবে জ্ঞান জীবনের সত্য উদ্দেশ্য উপলব্ধি করতে সাহায্য করে। তিনি কর্ম ও জ্ঞানকে সমন্বিত করে কর্মফল থেকে মুক্ত থাকার উপায় এবং স্বার্থহীন সেবার মাধ্যেমে মুক্তির পথ দেখিয়েছেন।
মূল শিক্ষা:
1. দিব্য জ্ঞানের গুরুত্ব: শ্রীকৃষ্ণ বলেন, এই জ্ঞান দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টায় এবং মানুষকে মোক্ষের দিকে নিয়ে যায়।
2. কর্মযোগ ও জ্ঞানযোগের সমন্বয়: ন্যায্য কর্ম করে যেতে হবে, কিন্তু তার প্রতি মোহ বা আসক্তি ছাড়াই।
3. গুরু বা জ্ঞানীর প্রয়োজন: সত্যজ্ঞান অর্জনে একজন যোগ্য গুরুর নির্দেশনার প্রয়োজন হয়।
4. সমভাবনায় জীবনযাপন: সফল ও ব্যর্থতা সমানভাবে গ্রহণ করা এবং ইন্দ্রিয়ের দাসত্ব থেকে মুক্ত থাকা।

42 শ্লোক

পঞ্চম অধ্যায়

কর্ম সন্ন্যাস যোগ

শ্রীমদ্ভাগবত গীতার পঞ্চম অধ্যায়, "কর্ম সন্ন্যাস যোগ," আমাদের কর্ম এবং সন্ন্যাসের মধ্যে সঠিক ভারসাম্যের শিক্ষা দেয়। এই অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বোঝান যে কেবল কর্ম ত্যাগ করাই মুক্তির পথ নয়; বরং কর্মের প্রতি আসক্তি ত্যাগ করাই গুরুত্বপূর্ণ।
এই অধ্যায়ের মূল শিক্ষা হলো:
1. কর্মে নিস্কামতা: কোনো ব্যক্তিগত লাভের প্রত্যাশা ছাড়া নির্লিপ্ত মনে কর্তব্য পালন করা উচিত।
2. যোগ ও সন্ন্যাসের সমন্বয়: সন্ন্যাস মানে সম্পূর্ণ কর্মবিরতি নয়, বরং তা মন ও চিত্তের শুদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয়।
3. অন্তর্মুখী শান্তি: যিনি কর্মফলকে ঈশ্বরের প্রতি উৎসর্গ করেন, তিনিই প্রকৃত শান্তি লাভ করেন।
4. সমদর্শিতা: জীবনের সব পরিস্থিতিতে সমান দৃষ্টি রাখার শিক্ষা এখানে দেওয়া হয়েছে।

29 শ্লোক

ষষ্ঠ অধ্যায়

ধ্যান যোগ

ষষ্ঠ অধ্যায়ে ধ্যান যোগের মাধ্যমে আত্ম-উন্নতি ও জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের পথ দেখানো হয়েছে। এই অধ্যায় আমাদের শেখায় যে মনকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং একাগ্রচিত্তে ধ্যান করা আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার সংযোগ স্থাপনের শ্রেষ্ঠ উপায়। ধ্যান যোগ চর্চার মাধ্যমে মানুষ তার মানসিক অস্থিরতা, মোহ ও ভোগবৃত্তি থেকে মুক্তি পেতে পারে।
গীতা এখানে বলেছে, যে ব্যক্তি সমদর্শী, স্থিতপ্রজ্ঞ এবং সুখ-দুঃখে সমান থাকে, সেই প্রকৃত যোগী। পাশাপাশি, নিজের কর্তব্যকর্ম সঠিকভাবে পালন করা এবং নিজের দায়িত্বে নিষ্ঠ থাকা ধ্যান যোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।
সংক্ষেপে, এই অধ্যায় আমাদের জীবনের ভারসাম্য রক্ষা, মনোসংযোগ বৃদ্ধি এবং প্রকৃত শান্তি লাভের জন্য ধ্যানের প্রয়োজনীয়তার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

47 শ্লোক

সপ্তম অধ্যায়

জ্ঞানবিজ্ঞান যোগ

শ্রীমদ্ভাগবত গীতার সপ্তম অধ্যায়, "জ্ঞানবিজ্ঞান যোগ", মানবজীবনে জ্ঞান ও বিজ্ঞানের গুরুত্ব এবং ভগবানকে জানার পথ সম্পর্কে শিক্ষা দেয়। এই অধ্যায়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জানান যে তিনি সৃষ্টির মূল কারণ এবং সবকিছুর ভিত্তি।
শিক্ষণীয় বিষয়:
1. জ্ঞান ও বিজ্ঞানের সংযোগ: শ্রীকৃষ্ণ বলেন, শুধুমাত্র তত্ত্বজ্ঞান নয়, তাঁর প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করাই প্রকৃত বিজ্ঞান।
2. ভক্তির মাধ্যমে উপলব্ধি: ঈশ্বরকে জানতে হলে ভক্তি, বিশ্বাস, এবং আত্মনিবেদন প্রয়োজন।
3. মায়ার প্রকৃতি: ভগবান তাঁর শক্তির মাধ্যমে সৃষ্টি করেন এবং সেই শক্তি মানুষকে মোহিত করে রাখে। এই মায়াকে অতিক্রম করতে ভক্তি ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান অপরিহার্য।
4. ভগবানের সার্বভৌমত্ব: শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে সৃষ্টির কারণ ও সমস্ত অস্তিত্বের কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
5. ভক্তির গুরুত্ব: ঈশ্বরের প্রতি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণই মুক্তির পথ।

30 শ্লোক

অষ্টম অধ্যায়

অক্ষরব্রহ্ম যোগ

অষ্টম অধ্যায় "অক্ষরব্রহ্ম যোগ" নামে পরিচিত, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে জীবন, মৃত্যু, পরমাত্মা এবং মোক্ষ সম্পর্কে জ্ঞান প্রদান করেন। এই অধ্যায়ের মূল বার্তা হলো:
1. অক্ষর ব্রহ্মের জ্ঞান: শ্রীকৃষ্ণ ব্যাখ্যা করেন যে পরমাত্মা চিরস্থায়ী ও অবিনশ্বর, যা "অক্ষর ব্রহ্ম" নামে পরিচিত। এটি মানবজীবনের সর্বোচ্চ লক্ষ্য।
2. চিন্তাধারা ও মৃত্যু সময়ের গুরুত্ব: মৃত্যুর সময় মন যে বিষয়ে কেন্দ্রীভূত থাকে, পরবর্তীতে আত্মা সেই অনুযায়ী গতি পায়। তাই ভগবানের স্মরণ ও চিন্তন সর্বদা গুরুত্বপূর্ণ।
3. ধ্যান ও যোগের প্রয়োজনীয়তা: ঈশ্বরের সাথে সংযুক্ত থাকতে হলে ধ্যান, যোগ, এবং একাগ্রতার চর্চা অত্যন্ত জরুরি।
4. ভক্তি ও পরম লক্ষ্য: ভক্তি এবং ঈশ্বরের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাসের মাধ্যমেই জীবের পরম গতি লাভ সম্ভব।
অষ্টম অধ্যায় আমাদের শেখায় যে মানবজীবন অস্থায়ী, কিন্তু আত্মা চিরন্তন। ঈশ্বরের চরণে আত্মসমর্পণ ও সৎকর্মের মাধ্যমে আমরা মুক্তি (মোক্ষ) লাভ করতে পারি।

28 শ্লোক

নবম অধ্যায়

রাজবিদ্যা রাজগুহ্য যোগ

শ্রীমদ্ভাগবত গীতার নবম অধ্যায়, "রাজবিদ্যা রাজগুহ্য যোগ", অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং গভীর শিক্ষার অধিকারী। এই অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে ব্রহ্মজ্ঞান, ভক্তি, এবং পরম সত্য সম্পর্কে গভীর শিক্ষা দেন। এটি রাজবিদ্যা বা সর্বোচ্চ জ্ঞান এবং রাজগুহ্য বা সর্বোত্তম গোপনীয়তার যোগ হিসেবে পরিচিত।
শিক্ষার মূল বিষয়:
1. ভক্তির মহিমা: ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ব্যাখ্যা করেন যে, ভক্তি যোগের মাধ্যমে যে কেউ, সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে, তাঁকে উপলব্ধি করতে পারে এবং মুক্তি লাভ করতে পারে।
2. ঈশ্বরের সর্বব্যাপিতা: শ্রীকৃষ্ণ সবকিছুর মধ্যে বিরাজমান এবং সমস্ত সৃষ্টি তাঁর মধ্যেই নিহিত। তিনি সৃষ্টির কারণ ও ধারণকারী শক্তি।
3. নিঃস্বার্থ সেবা: নিঃস্বার্থভাবে যে কর্ম ও ভক্তি ভগবানের প্রতি নিবেদন করা হয়, তা পরম কল্যাণ ও মুক্তির পথপ্রদর্শক।
4. অকপট বিশ্বাসের গুরুত্ব: শ্রীকৃষ্ণ বলেন, "যে ব্যক্তি আমাকে পূর্ণ বিশ্বাস ও ভক্তির সাথে স্মরণ করে, সে জীবনের সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে আমাতে লীন হয়।"

34 শ্লোক

দশম অধ্যায়

বিভূতি যোগ

শ্রীমদ্ভাগবত গীতার দশম অধ্যায় (বিভূতি যোগ) আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ভগবানের সর্বব্যাপী উপস্থিতি এবং তাঁর অসীম ক্ষমতার শিক্ষা দেয়। এই অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বোঝাচ্ছেন যে জগতের প্রতিটি শ্রেষ্ঠত্ব, শক্তি এবং সৌন্দর্য ভগবানের বিভূতির প্রকাশ। তিনি বলেন, প্রকৃতি, প্রাণী, মানুষ এবং ব্রহ্মাণ্ডের সেরা গুণাবলী তাঁরই অংশ।
এই অধ্যায় থেকে আমরা শিখি:
1. ভগবানের সর্বব্যাপিতা: জীবনের প্রতিটি ভালো কাজ এবং উন্নত মানসিক গুণের পেছনে ভগবানের অনুগ্রহ রয়েছে।
2. নম্রতা ও কৃতজ্ঞতা: আমাদের অর্জন ও গুণাবলীর প্রতি অহংকার না করে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।
3. দর্শনের গভীরতা: সৃষ্টির সৌন্দর্য এবং শক্তির মধ্যে ঈশ্বরের উপস্থিতি উপলব্ধি করার শিক্ষা পাই।
4. আত্মবিশ্বাস ও ধার্মিকতা: জীবনের যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিতে ভগবানের প্রতি বিশ্বাস রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
উপসংহার: এই অধ্যায় আমাদের আধ্যাত্মিক উপলব্ধি এবং জীবনের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনে সহায়তা করে।

42 শ্লোক

একাদশ অধ্যায়

বিশ্বরূপদর্শন যোগ

শ্রীমদ্ভাগবত গীতার একাদশ অধ্যায়, "বিশ্বরূপদর্শন যোগ," আমাদের জীবনের গভীর দর্শন এবং আধ্যাত্মিকতার মূল্যবান পাঠ দেয়। এই অধ্যায়ে অর্জুন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সর্বজনীন রূপের দর্শন লাভ করেন, যা সমগ্র সৃষ্টির অন্তর্নিহিত ঐক্য ও ভগবানের অসীম ক্ষমতার পরিচায়ক।
এই অধ্যায় থেকে আমরা যে শিক্ষা পাই তা হলো:
1. ভক্তি ও বিশ্বাসের গুরুত্ব: ভগবানকে অনুভব করতে হলে নিঃস্বার্থ ভক্তি এবং গভীর বিশ্বাস প্রয়োজন।
2. জগতের ঐক্য: সমগ্র সৃষ্টিই এক অপরিহার্য অংশ, যেখানে ভগবান সর্বত্র বিরাজমান।
3. অহংকার পরিহার: ভগবানের অসীম ক্ষমতার সামনে আমাদের উচিত নম্রতা ও বিনয় প্রকাশ করা।
4. কর্মের গুরুত্ব: নিজের দায়িত্ব পালন করতে হবে ভগবানের প্রতি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের মনোভাব নিয়ে।
এই অধ্যায় আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা, ভগবানের প্রতি ভক্তি, এবং নৈতিকতার পথে জীবনযাপনের প্রতি অনুপ্রাণিত করে।

55 শ্লোক

দ্বাদশ অধ্যায়

ভক্তি যোগ

শ্রীমদ্ভাগবত গীতার দ্বাদশ অধ্যায় "ভক্তি যোগ" ভক্তির সর্বোচ্চ রূপ ও তার গুরুত্ব সম্পর্কে শিক্ষা দেয়। এই অধ্যায়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভক্তের বিভিন্ন স্তরের গুণাবলি ব্যাখ্যা করেন। ভক্তি যোগের মূল শিক্ষা হলো, ঈশ্বরের প্রতি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ, বিশ্বাস, এবং প্রেমের মাধ্যমে জীবনের মোক্ষ অর্জন করা।
ভক্তির পথ অনুসরণে করুণাময়, অহিংস, সত্যবাদী, সমদর্শী, লোভ-মুক্ত, এবং দৃঢ় বিশ্বাসী হওয়ার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে আমরা শিখি কিভাবে মানসিক শান্তি এবং আত্মার উন্নতি সম্ভব। শ্রীকৃষ্ণ বলেন, নির্গুণ ব্রহ্মচিন্তনের তুলনায় ঈশ্বরকে ব্যক্তিগতভাবে পূজা করা সহজ এবং ফলপ্রসূ।
এই অধ্যায় আমাদের প্রেম, বিশ্বাস, এবং সহানুভূতির পথে এগিয়ে যেতে এবং দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে অনুপ্রাণিত করে।

20 শ্লোক

ত্রয়োদশ অধ্যায়

ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞ বিভাগ যোগ

শ্রীমদ্ভাগবত গীতার ত্রয়োদশ অধ্যায় (ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞ যোগ) মূলত শারীরিক এবং আধ্যাত্মিক স্তরের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে। এই অধ্যায়ে, শ্রীকৃষ্ণ মহাভারতের যুগে অর্জুনকে ব্যাখ্যা করেন যে, শরীর একটি ক্ষেত্র (ক্ষেত্র) এবং আত্মা সেই ক্ষেত্রের জানক (ক্ষেত্রজ্ঞ)। জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য হল এই ক্ষেত্র এবং ক্ষেত্রজ্ঞের মধ্যে সম্পর্ক বোঝা, তাদের মধ্যে অমলতা এবং একাত্মতা অর্জন করা।
এছাড়াও, এই অধ্যায় থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি যে, দেহের প্রকৃতি, কর্মের ধারাগুলি এবং আত্মার অভ্যন্তরীণ স্বরূপের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি করে আত্মজ্ঞানে পৌঁছানো সম্ভব। এই অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ ব্যাখ্যা করেন, "ক্ষেত্র" বা দেহের সীমানার মধ্যে পরম সত্যের সন্ধান করা সম্ভব, যার মাধ্যমে আমরা আমাদের আধ্যাত্মিক লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য বুঝতে পারি।
এই শিক্ষাগুলি আমাদের জীবনকে উচ্চতর মানসিকতা, শান্তি এবং তৃপ্তি অর্জনের দিকে পরিচালিত করতে সাহায্য করে।

34 শ্লোক

চতুর্দশ অধ্যায়

গুণত্রয়বিভাগ যোগ

শ্রীমদ্ভাগবত গীতার চতুর্দশ অধ্যায় (গুণত্রয়বিভাগ যোগ) মূলত মানুষের প্রকৃতি, গুণ, এবং চরিত্রের ওপর আলোচনা করে। এই অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ বলেন যে, মানুষের আচরণ এবং জীবনের গুণাবলী তিনটি প্রধান গুণের প্রভাবে পরিচালিত হয়: সত্ত্ব, রাজস, এবং তামস।
১. সত্ত্ব গুণ: এটি সত্য, জ্ঞান, পবিত্রতা এবং নিরপেক্ষতার প্রতীক। সত্ত্ব গুণে অবধি উন্নীত হলে ব্যক্তি আত্মসাক্ষাৎ লাভ এবং সত্য পথের অনুসরণ করে।
২. রাজস গুণ: এটি ক্রিয়া, ইচ্ছা, লোভ, এবং কামনার প্রতীক। রাজস গুণে আক্রান্ত ব্যক্তি জগতের প্রতি আকর্ষিত থাকে এবং সাফল্য ও অর্জনের পেছনে দৌড়ায়।
৩. তামস গুণ: এটি অজ্ঞতা, হতাশা, এবং নির্বিকারতার প্রতীক। তামস গুণে আক্রান্ত ব্যক্তি আলস্যপূর্ণ, ন্যায়বোধহীন এবং অলস হয়ে পড়ে।
গীতার এই অধ্যায় আমাদের শেখায় যে, আত্মউন্নতি এবং প্রকৃত সুখ অর্জন করার জন্য আমাদের সত্ত্ব গুণের দিকে ধাবিত হতে হবে এবং রাজস ও তামস গুণ থেকে দূরে থাকতে হবে। এটি একটি আত্মবিশ্লেষণের আহ্বান, যেখানে আমরা নিজেদের মধ্যে এই গুণগুলোর প্রভাব বুঝে আমাদের আচার-আচরণকে সংশোধন করতে পারি।

27 শ্লোক

পঞ্চদশ অধ্যায়

পুরুষোত্তম যোগ

শ্রীমদ্ভাগবত গীতার পঞ্চদশ অধ্যায় (পুরুষোত্তম যোগ) একটি গভীর আধ্যাত্মিক পাঠ যা মানুষের জীবন ও আধ্যাত্মিক চেতনাকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা প্রদান করে। এই অধ্যায়ে শ্রী কৃষ্ণ আমাদের আত্মার প্রকৃতি, দেহের মায়া এবং ব্রহ্মের সাথের সম্পর্ক বোঝান।
শিক্ষা:
১. দেহের মায়া থেকে মুক্তি: দেহের প্রতি নির্ভরশীলতা এবং তার মায়া সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে, যা একে একে আমাদের আত্মার প্রকৃত অবস্থান থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়।
২. আত্মপরিচয় ও পরমাত্মার অভেদ: আত্মার সত্যিকার পরিচয় উপলব্ধি করতে হবে এবং আমাদের নিজস্ব আত্মার সাথে পরমাত্মার সম্পর্কের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হবে।
৩. ভগবানের প্রতি বিশ্বাস ও ভক্তি: কৃষ্ণ, বা পরমপুরুষ, পরমাত্মার শ্রীচরণে আত্মনিবেদন করে আত্মশুদ্ধি লাভ করার পথ নির্দেশনা দিয়েছেন।
এই অধ্যায়টি আমাদের শিখায় যে, পৃথিবীসর্বস্ব মায়ার প্রতি আসক্তি ত্যাগ করে পরমেশ্বরের পথে চলতে হবে, যেখানে ভক্তি, যোগ এবং আত্মজ্ঞানের মাধ্যমে মুক্তি লাভ সম্ভব।

20 শ্লোক

ষোড়শ অধ্যায়

দৈবাসুর সম্পদ্বিভাগ যোগ

শ্রীমদ্ভাগবত গীতার ষোড়শ অধ্যায় (দৈবাসুর সম্পদ্বিভাগ যোগ) আমাদের জীবনে ধর্ম ও অধর্মের পার্থক্য, সৎ ও অসৎ চরিত্রের বৈশিষ্ট্য, এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রদান করে। এই অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ দৈব ও আসুরিক গুণাবলীর বিবরণ দিয়েছেন, যেখানে দৈব গুণগুলি মানুষকে আধ্যাত্মিকতার দিকে পরিচালিত করে এবং আসুরিক গুণগুলি তাকে নেমে যেতে প্ররোচিত করে।
দৈব গুণাবলী যেমন- দয়া, সত্য, পরোপকার, অহংকারহীনতা, এবং আত্মনির্ভরশীলতা একজন মানুষকে সৎ পথে চলতে সহায়ক। অন্যদিকে, আসুরিক গুণাবলী যেমন- অহংকার, রাগ, দুশ্চিন্তা, এবং অন্যের ক্ষতি করার প্রবণতা মানুষকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়।
শ্রীকৃষ্ণ এই অধ্যায়ে শিক্ষা দেন যে, একজন মানুষের গুণাবলী তার চরিত্র ও ভবিষ্যতের পথ নির্ধারণ করে, এবং সেই অনুযায়ী তাকে আত্মবিশ্লেষণ এবং আত্মউন্নতির দিকে মনোনিবেশ করতে হবে।
এই অধ্যায়ের মাধ্যমে আমাদের শিখতে হবে যে, ভালো গুণাবলীর চর্চা আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতির দিকে নিয়ে যায় এবং জীবনে সত্য, দয়া ও সহানুভূতির পথে চলা উচিত।

24 শ্লোক

সপ্তদশ অধ্যায়

শ্রদ্ধাত্রয় বিভাগ যোগ

শ্রীমদ্ভাগবত গীতার সপ্তদশ অধ্যায়, "শ্রদ্ধাত্রয় বিভাগ যোগ", শ্রদ্ধার তিনটি প্রকার—সাত্ত্বিক, রাজসিক, এবং তামসিক—বর্ণনা করেছে। এই অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ বলেন যে, মানুষের শ্রদ্ধা তার মনোভাব ও কর্মের ভিত্তিতে তিনটি ভিন্ন ধরনের হতে পারে।
১. সাত্ত্বিক শ্রদ্ধা: যে শ্রদ্ধা পরিশুদ্ধ, দয়ালু, এবং আত্মসত্যের প্রতি নিবদ্ধ থাকে। এটি ঈশ্বরের প্রতি নির্ভরশীল ও আত্মবিশ্বাসী।
২. রাজসিক শ্রদ্ধা: যা নিজস্ব লাভ ও বিশ্বসামাজিক প্রাপ্তির জন্য অন্যদের শোষণ করতে প্রেরণা দেয়।
৩. তামসিক শ্রদ্ধা: যা অন্ধবিশ্বাসে পূর্ণ এবং অজ্ঞতা ও দুর্বলতার জন্ম দেয়।
এই অধ্যায়ের মাধ্যমে আমরা শিখতে পারি, আমাদের শ্রদ্ধার ধরন কেমন তা আমাদের জীবনের মানসিকতা ও কর্মের ওপর প্রভাব ফেলে। শ্রীকৃষ্ণ জানান যে, সত্য ও ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা হওয়া উচিত যাতে আমরা আত্মমুক্তির পথে এগোতে পারি।

28 শ্লোক

অষ্টাদশ অধ্যায়

মোক্ষক্ষেত্র যোগ

শ্রীমদ্ভাগবত গীতার অষ্টাদশ অধ্যায়, "মোক্ষক্ষেত্র যোগ", সর্বোপরি মানুষের মুক্তি অর্জনের পথ এবং ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্যের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করে। এই অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে শেষ পরামর্শ দেন, যেখানে তিনি মানবজীবনের উদ্দেশ্য, ধর্ম, কর্ম, যোগ, ও সচ্চিদানন্দের ধারণা তুলে ধরেন।
এটি মূলত তিনটি প্রধান দিশার দিকে নির্দেশ করে:
1. কর্মযোগ: মানুষের কাজ সৎ উদ্দেশ্যে, ঈশ্বরের প্রতি সমর্পণ করা উচিত, যাতে সে মুক্তির পথে এগিয়ে যেতে পারে।
2. ভক্তি যোগ: শুদ্ধ ভক্তির মাধ্যমে ঈশ্বরের সাথে একত্বতা লাভ এবং তাঁর অসীম মহিমার প্রতি আত্মসমর্পণ।
3. জ্ঞানযোগ: জ্ঞান ও আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে সত্যের উপলব্ধি এবং আত্মা-পরিচয়ের অর্জন।
এই অধ্যায়ের শিক্ষা আমাদের শেখায়, আমাদের কর্ম যেন শুদ্ধ হয়, আমাদের মন যেন ঈশ্বরের প্রতি ভক্তিতে পূর্ণ থাকে এবং আমরা সত্যের পথ অনুসরণ করি, যাতে আমরা মোক্ষ বা মুক্তির দিকে এগিয়ে যেতে পারি।

78 শ্লোক